ছোট্ট চিঠি
-প্রিন্স ঠাকুর
প্রিয় মানসী,
দিন যেতে যেতে যায়। বেলা গড়িয়ে বিকেল। তখনও গোঁধূলীর বেলাভূমিটা অতটা রক্তিম হয়ে ওঠেনি, সারি সারি মেঘের ভেলা কিভাবে যে ওড়ে, কোথায় যায়, সেই ধারনার মর্মতলে পৌঁছাতে পারিনি এখনও। এলোমেলো সব চিন্তাগুলো মাথার পুরোটা জায়গা দখল করে নিয়েছে। ভাবতে থাকি তোমায়… লিখতে থাকি চিঠি। কলমের বুক চিরে বের হয় কালো রক্ত। সেই রক্তের কালিতে দু’কলম লেখা-
“আমার কাছে আসতে হবে, একটু ভালবাসতে হবে
বাহিরে নয় বাহিরে নয়, ভিতর জ্বলে ভাসতে হবে-
আমায় ভালবাসতে হবে, ভীষণ ভালবাসতে হবে।”
এইসব ইত্যাকার ইতিকথা আমার ডায়েরীর এপিটাকে লিখে রেখে চেয়েছি একবার মেঘ হবো। একবার ভেবেছি শ্রাবণের জ্বলে ভাসিয়ে দেবো আমার মনের সব ব্যাকুলতা। তা স্বত্বেও পৃথিবীর কোন মূল্যে এই প্রথম টের পাচ্ছি আমি একেবারে তোমার সুবর্ণ নদীর তীরে এসে পৌঁছে গেছি। একচুলও এদিক ওদিক হলে তোমার ঐ ভরা নদীতে অনন্ত স্নান। যেহেতু, প্রেম থাকে সাপের ফনায় জর্জরিত বীষে। সেহেতু ধনুকের সীলায় জন্ম নিয়েও সোনার পাখিটি শিকার করতে পারেনি বন্ধুদের কেউ কেউ। আমি আমাকে ধন্য মনে করি। কারণ, আমার মনের ময়না পাখিটির সন্ধান আমি পেয়েগেছি। মন যাকে চায়, যাকে একান্ত ভাবে অনুভব করা গেল তাই তুমি, তাই বাস্তব। তুমি ছাড়া আর কোন তীর্থ নেই আমার ভালবাসার শাস্ত্রীয় প্রার্থনায়।
সোনা বউ, মহীনের ঘোড়াগুলি কি ঘোর পূর্ণিমায় ঘাস খেতে নেমে আসবে না মাটির পৃথিবীতে? তুমি কি পারনা তোমার ঐ হস্তিনাপুরের আলাইপুরে আমাকে নিয়ে যেতে? তোমার কোলে মাথা রেখে একটু স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতে আমার যে বড্ড ইচ্ছে হয়।
গভীর রাত। চারিদিকে নিস্তব্দ, নিঝুম। পৃথিবী ঘুমায়। ঘুম নেই আমার দু’চোখে। এদিক সেদিক, দুরে কাছে চোখের দৃষ্টিরা ঘুরে বেড়ায়। ঘরের জানালায় জোছনার আলোর সেকি মাখামাখি। আমি বেলকনিতে ইজি চেয়ারে বসে পায়ের উপর পা রেখে দোল খাচ্ছি আর অসম্ভব সুন্দরে ভরা চাঁদের আলো গায়ে মাখছি। আঁধারের মাঝে শতশত হাজার হাজার তারায় ঘেরা জ্বলজ্বলে আকাশটাকে দেখতে বাদ দেয়নি দু’নয়ন। বেলকনিতে প্রাণ জোড়ানো ঝিরঝিরে হিম শীতল বাতাসের আনাগোনা। যে বাতাসে রাতে ফোঁটা ফুল হাসনাহেনা ও বেলী ফুলের সুবাস জড়িয়ে আছে। এমন সময় হৃদয় কোণে শূণ্যতার অনুভূতি। একলা থাকায় বিষাদের ছিটেফোঁটা। এই রাতেই কাছে পেতে চাচ্ছিলাম সেই মেয়েটিকে যে কিনা আমার চোখের ক্লান্তিতে লেগে আছে সর্বক্ষন। যার মুখখাণি দেখার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকে সকাল দুপুর রাত।
ধান ক্ষেতের সবুজকে তোমার এত ভাললাগা চাইযে-এত ভাললাগা চাইযে, তোমার স্বত্বার অন্তহীন পরিচয়ে ঐ পরিচয়টুকু যুক্ত হলো। ভোরে উঠুক সবুজে সবুজ, সজিবতা আর ছোট্ট সবুজ প্রাণ। সবুজ মনে হোক অবুঝ মনের আনাগোনা। স্বপ্ন ছুয়ে যাক্ তোমার পদ্মদীঘির বুকে। চুম্বন রসে সিক্ত হয়ে ভিজে যাক্ তোমার অষ্ঠো যুগোল। আমার চোখের ছায়ায় তুমিইতো দেখেছিলে হাজার বছরের স্বপ্ন। যে স্বপ্নের তুমিই ছিলে সার্বক্ষনিক অংশীদার। বধূয়া বলো, সেই স্বপ্ন, সেই প্রেম কিভাবে উপেক্ষা করি।
কেমন আছো, জানাবে নিশ্চয়ই। আমি মোটেও ভালো নেই। কারণ, সব চেয়ে আপন মানুষটি আমার কাছ থেকে অনেক দুরে। সে যে তুমি তা নিশ্চয়ই নতুন করে বলে দেওয়ার অপেক্ষা রাখে না। কেমন আছো, কি খবর কিছুই জানিনা। আমি তোমাকে যে কি পরিমান ভালবাসি, বিশ্বাস করি সে শুধু জানি আমি আর জানেন আমার অন্তরজামী ঈশ্বর। আর কেউ তা জানে না, কোনদিন জানবেও না। সেই আমি কি তোমাকে কষ্ট দিতে পারি? আত্মার সম্পর্ক কখনও ছিন্ন হবার নয়। তোমার সাথে যে আমার আত্মার সম্পর্ক রয়েছে, থাকবে চিরদিন। সৃষ্টিকর্তা ভালোদের ভালো কিছুই দেন এবং তা কেড়ে নেন না। এটা অতিব বাস্তব, সত্যিকথা।
চিঠিই হচ্ছে ভালবাসার জীবন। তাই একটা সময় আসে, যখন চিঠি লেখার প্রয়োজনটা মনে হয় বেশি করে অনুভব করতে হয়। ভালবাসাকে বুঝতে অনুভুতি ও সময় দেওয়ার প্রয়োজন হয়। সেই প্রয়োজনটা বোধ হয় আমাদের থাকা উচিৎ। পাশাপাশি পারস্পরিক মূল্যবোধ, চাওয়া ও পাওয়া এবং ভালবাসার মানুষকে চিঠি লেখার দায় থাকাও প্রয়োজন। তোমার চিঠি পাওয়া থেকে আমাকে বঞ্চিত করোনা লক্ষিটি, প্লিজ। একটু সময় করে লিখো। তোমার ভালবাসাকে ভুলিনি। তুমি আমাকে কতোদিন ধরে লিখছোনা, একবারও কি ভেবে দেখনি? আমাকে তুমি লিখছোনা এই চিন্তা ইদানিং আমাকে আহত করে ফেলেছে। তোমার জন্য আমার হৃদয়ে তো আন্তরিকতার কোন অভাব নেই। তাহলে বলতে পারো লক্ষিটি চিঠি না লেখার কি কারণ থাকতে পারে? তোমার ভালবাসা থেকে আমাকে এক মুহুর্তের জন্যে বিচ্ছিন্ন করতে পারে এমন কিছু আকর্ষনীয় আমার নেই। ভালবাসা এমন এক সম্পদ যা সবার মাঝে ভাগ করা যায় না। তাই, আমি তা পারি না। তোমাকে হারাতে পারবো না কোনদিন।
ইতি-
ভালবাসায় সিক্ত, সেই আমি।
০৫.০৩.১৯৯৮ ইংরেজি, খুলনা আর্ট কলেজ হোষ্টেল।
Share