গৌরাঙ্গদেব চক্রবর্ত্তী
-প্রিন্স ঠাকুর
পুরো নাম গৌরাঙ্গদেব চক্রবর্ত্তী গৌর, ডাক নাম গৌর। তিনি গৌর ঠাকুর/গৌর স্যার নামে অধিক পরিচিত। তাঁর জন্ম ২৪ জুলাই, ১৯৪৩ খ্রীষ্টাব্দে বাংলাদেশের নড়াইল জেলাধীন বিছালী ইউনিয়নে অবস্থিত রুন্দিয়া গ্রামের সম্ভ্রান্ত ব্রাক্ষণ পরিবার ঠাকুরবাড়ী। পিতা স্বর্গীয় রসিক লাল চক্রবর্ত্তী, মাতা স্বর্গীয়া শৈলবালা রানী চক্রবর্ত্তী। এক বোন ও তিন ভাইয়ের মধ্যে তিনি মেঝো ছিলেন। পরিবারের অভিভাবক এর দায়িত্বভার ছিল তাঁর উপর।
ছোটবেলা থেকেই কবিতার প্রতি তাঁর প্রবল আকর্ষন ছিল। বানিয়ে বানিয়ে গল্প বলার অভ্যাসটাও ছিল বেশ। তাই স্কুল জীবনে প্রতিযোগীতামূলক বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে কবিতা ও প্রবন্ধ লিখে জ্ঞানী গুণীদের ভূয়সী প্রশংসা অর্জন করেছেন। তদানীন্তন পাকিস্তান আমলে কলেজ জীবনে ত্রৈমাসিক “সবুজের ডাক” নামক হস্তলিখিত পত্রিকার সম্পাদনা করেছেন। পত্রিকায় প্রকাশিত সকল কবিতার মধ্যে তার লেখা ‘সবুজের ডাক’ নামক কবিতাটি তরুন সমাজে বিশেষ সাড়া জাগিয়েছিল। তাছাড়া পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল মুহম্মদ আয়ুব খানের “Friend not master” নামক আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থের সমালোচনা করে ছাত্র সংগঠনের পূরোধা হয়ে সহপাঠীদের নিয়ে ক্লাস বর্জন করেন। কারন, ঐ গ্রন্থই ছিল তৃতীয় বর্ষের তৃতীয় পর্বের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বাধ্যতামূলক পাঠ্য বিষয়।
তিনি পাকিস্তানামলে ইংরেজি বিষয়ে বিএ পাশ ডিগ্রী অর্জন করেছেন। পিতা মাতাকে হারিয়ে সংসারের সকল দায়ভার এসে পড়ে তার উপর। সংসারের দায়িত্বভারে হিমশিম খেতে খেতে বৈবাহিক জীবনে সহধর্মিনী হিসেবে অনিমা রানী চক্রবর্তীকে পরিবারের সদস্য হিসেবে যোগ করালেন। পরবর্তিতে দেশে যুদ্ধ শুরু হলো। হিন্দুদের উপর নির্যাতন, লুটপাট, ঘরবাড়ি জবরদখল চলাকালীন সময়ে পড়াশোনা করাটা আর হয়ে ওঠেনি। যুদ্ধপরবর্তী জীবনে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা পেশায় তিনি আত্মনিয়োগ করেন। অবসরে নিজ এলাকার ছেলেমেয়েদের শিক্ষার আলোয় আলোকিত করার লক্ষ্যে নিজ বাড়ীতেই নাম মাত্র বেতনে তাদের পড়াতে শুরু করেন। সেই সাথে গরিব ছাত্রছাত্রীদের বেতন ছাড়াই একদম ফ্রিতে পড়াতেন।
ইংরেজি ভাষায় জ্ঞান ছিল তাঁর অঘাদ। যে কারণে, শুধু আশপাশের গ্রামের ছেলেমেয়ে নয়, দুর্দুরান্ত থেকে অনেক ছাত্রছাত্রীরা পড়ার জন্য এসে ভীড় করতো রুন্দিয়ার এই ঠাকুরবাড়ীতে গৌর স্যারের কাছে। আর তাই নিজের খাওয়া ঘুম বাদ দিয়ে ওই সব ছেলেমেয়েদের পড়ানোটাই ছিল যেন তাঁর আনন্দ বা দায়িত্ব। সেই সাথে নিজেও আনন্দ পেতেন।
ইংরেজি ভাষাজ্ঞানের পাশাপাশি সংস্কৃতভাষা তথা সনাতন ধর্মীয় জ্ঞান ছিল অনেক বেশি। পাশাপাশি ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে তার জানা ছিল। সেই কারণেই সবার মাঝে ধর্মীয় জ্ঞান জাগাতে মাঝে মাঝে নিজ বাড়িতে পাড়ার লোকজন নিয়ে আলোচনায় বসতেন। মন্দিরের পূজার্চণার ফাঁকে ধর্মীয় আলোচনা করতেন। যার দরুন এলাকায় তিনি হিন্দু, মুসলিম সকলের শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তি হিসেবে বসবাস করেছেন এবং মহল্লার পঞ্চায়েতের দায়িত্বও পালন করেছেন। তিনি নওয়াপাড়া মডেল কলেজের খ-কালীন শিক্ষক হিসেবে ইংরেজি পাঠ্যবিষয়ের শিক্ষাদান করেছেন।
সমস্ত কাজের মাঝে তিনি কবিতা, প্রবন্ধ লিখেছেন। তবে তিনি কবিতাকে পেশা হিসেবে গ্রহন করেননি। স্বত:স্ফূর্ত আনন্দরসধারা প্রবাহই তাঁর কবিতা রচনার উৎস ছিল। তবে পারিপার্শ্বিক চেতনাবোধ ও যে তাঁর চিন্তাধারাকে প্রভাবান্বিত করেনি তা বলা যায় না। শুধু বাংলা কবিতা লিখতেন তা নয়, ইংরেজী কবিতা রচনার কথা উল্লেখ করলে বোধ হয় অত্যুক্তি হবে না। তিনি ইংরেজি কবিতা লেখায় ছিলেন অধিক পারদর্শী। এই ইংরেজী কবিতা লেখার অনুপ্রেরনা যুগিয়েছিলেন তাঁর শ্রদ্ধেয় শিক্ষক প্রয়াত নকুল কর মহাশয়। তিনি তাঁর ইংরেজি কবিতা পড়ে প্রশংসা করে বলতেন, ‘গৌর, তুমি লেখাটা চালিয়ে যাও, তোমার লেখা চমৎকার।’ এমতাবস্থায় দুঃখের বিষয় এই যে, নিজের শারীরিক অসুস্থতা ও পারিবারিক জটিলতার কারণে এবং নানা ব্যস্ততায় লেখালেখিটা নিয়মিত করতে পারেননি, সেই সাথে নিজের লেখা কবিতা বা প্রবন্ধ দিয়ে বই প্রকাশও করতে পারেননি। শত দুঃখ-কস্ট, সংসার, ছেলেমেয়েদের মানুষ করার দায়িত্ববোধের চাপে পড়ে নিজের সুখ আহ্লাদ পুরো করতে পারেননি তিনি।
অবশেষে আমি (প্রিন্স ঠাকুর) তাঁর লেখা বাংলা ও ইংরেজি কবিতা মিলিয়ে কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করার ব্যবস্থা গ্রহন করি। তাঁর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের নাম ‘সপ্তবর্ণা’ অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০১৯ খ্রীস্টাব্দ। শফিক সাইফুল সম্পাদিত ‘বাংলাদেশের কবি ও কবিতা’ নামক গ্রন্থেও তাঁর লেখা কবিতা প্রকাশিত হয়েছে।
২৩ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪ খ্রীষ্টাব্দে হঠাৎ হৃদযন্ত্রের কার্যকারিতা বন্ধ হয়ে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল সত্তুর বছর ছয় মাস উনত্রিশ দিন। মৃত্যুর সময় উত্তরাধিকারী হিসেবে সহধর্মিনী অনিমা রানী চক্রবর্তী এর সহিত দুই ছেলে, দুই বৌমা, এক মেয়ে ও এক নাতনীকে রেখে যান। বড় ছেলে গৌতম বুদ্ধ চক্রবর্ত্তী, বিএসসি অনার্স (পদার্থ বিজ্ঞান), বিএড (গণিত শিক্ষক, খড়রিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়); বড় বৌমা রূপা রানী রায়, এমএসএস (গৃহিণী); নাতনী গোধুলী রানী চক্রবর্ত্তী ইচ্ছে। ছোট ছেলে প্রবীর চক্রবর্ত্তী প্রিন্স ঠাকুর, এমএফএ (মাস্টার্স অফ ফাইন আর্টস) (চিত্রশিল্পী, ক্রিয়েটিভ ডিজাইনার, কবি ও লেখক); ছোট বৌমা দিপালী রানী চক্রবর্তী, এমএসএস, বিএড (শিক্ষীকা, সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়); মেয়ে শিল্পী রানী চক্রবর্ত্তী, এমবিএস ও সংস্কৃত-মধ্য।
